উখিয়ার আলোচিত ফোর মার্ডার রহস্যের বেড়াজালে

শংকর বড়ুয়া রুমি : 

উখিয়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একই পরিবারের চারজনকে জবাই করে হত্যা ঘটনার ২২ দিন পরও মামলার কোন ধরণের অগ্রগতি নেই; তবে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার ২ জনকে ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

মামলার তদন্ত সংশিষ্টরা জানিয়েছেন, বুধবার দুপুরে ঘটনায় গ্রেপ্তার রিকু বড়ুয়া ও উজ্জল বড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাওয়া হলে উখিয়া আদালতের বিচারক মো. হেলাল উদ্দিন ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নিহতদের ২ জন নিকটাত্মীয়কে গ্রেপ্তার করলেও এখনো রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে পুলিশ মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে হস্তান্তর করেছে।

 

 

 

 

এদিকে স্বজনদের মন্তব্য, ঘটনায় গ্রেপ্তার ২ জন নিকটাত্মীয়ের জড়িত থাকার বিষয়টি তারা (স্বজনরা) কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। তারপরও ঘটনায় জড়িত প্রমান পেলে বিচারের দাবি তাদের।

পিবিআই এর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সবে মাত্র কয়েকদিন হয় মামলাটি পিবিআই এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তদন্তকাজ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। মামলার সার্বিক দিক বিবেচনা করে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে বা দিবাগত রাতের যে কোন সময় উখিয়া উপজেলার রত্মাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্মাপালং গ্রামের বাসিন্দা মৃত প্রবীন বড়ুয়ার ছেলে কুয়েত প্রবাসী রোকেন বড়ুয়ার বাড়ী ৪ জনকে জবাই করে খুনের ঘটনা ঘটে। এরা হল, রোকেন বড়ুয়ার মা সুখী বালা বড়ুয়া (৬৫), স্ত্রী মিলা বড়ুয়া (২৬), ছেলে রবীন বড়ুয়া (৫) ও ভাই শিপু বড়ুয়ার মেয়ে সনি বড়ুয়া (৬)।
ঘটনার দিন রোকেন বড়ুয়া কুয়েতে অবস্থান করছিলেন। স্বজনদের মৃত্যুর খবরে ঘটনার পরদিন দেশে ফিরেন।

 

 

 

 

ঘটনার পরে রোকেন বড়ুয়ার শ্বশুর এবং নিহত মিলা বড়ুয়ার বাবা শশাংক বড়ুয়া বাদী হয়ে এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা হয়েছে।
পরবর্তীতে ঘটনার ১৫ দিন পর জড়িত সন্দেহে পুলিশ রোকেনের বৌদি ও নিহত সনি বড়ুয়ার মা রিকু বড়ুয়া এবং ভাগিনী জামাই উজ্জল বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করে।
এ নিয়ে পুলিশ জানিয়েছিল, ঘটনায় জড়িত প্রমান পাওয়ায় এই ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা ঘটনায় প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় উখিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ ফারুক। পরে তা হস্তান্তর করা হয় পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নুরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে। পরে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে হস্তান্তর করা হয়।

 

 

 

 

উখিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি) মো. আবুল মনসুর বলেন, চাঞ্চল্যকর এ খুনের ঘটনাটির রহস্য উদঘাটনে পুলিশ মামলার বাদী, স্বাক্ষী ও নিহতদের স্বজন-প্রতিবেশীসহ অন্তত ২০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
“ ঘটনায় জড়িত প্রমান পাওয়ায় ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের আদালতে প্রেরণ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। ”
পরবর্তীতে গত ১১ সেপ্টেম্বর পুলিশ মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান ওসি মনসুর।
এদিকে পিবিআই কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন জানান, গ্রেপ্তার ২ জনকে বুধবার দুপুরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাওয়া হলে উখিয়া আদালতের বিচারক মো. হেলাল উদ্দিন ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আগামী শনিবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ঘটনার রহস্য জানতে বুধবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শন করা হয় উখিয়ার রত্নাপালং  ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং গ্রামের কুয়েত প্রবাসী রোকেন বড়ুয়ার বাড়ী। সেখানে কথা হয় রোকেনসহ নিহতদের কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২ জন নিকটাত্মীয় গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়েও আলাপ ঘটে।
এসময় বাড়ীটিতে অবস্থানকারি রোকেনের বড় বোন বেনু বড়ুয়া বলেন, গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে মিলা বড়ুয়া ছেলে রবীন বড়ুয়াসহ কেনাকাটা করতে কোটবাজার স্টেশনে যান। এসময় তিনিও সঙ্গে ছিলেন। তিনি অন্যান্য কেনাকাটা শেষে মিলাকে মায়ের জন্য আধা-কেজি আপেল কিনে দেন। পরে তিনি সন্ধ্যা দিকে মিলাকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে নিজ বাড়ীতে রওনা দেন।
তিনি বলেন, নিকটাত্মীয়দের মধ্যে এমন কোন লোক নেই; যারা এ ধরণের পাশবিক ঘটনা ঘটাতে পারে। এটি কল্পনায়ও আনা যায় না।
“ ছোটখাট পারিবারিক অমিল থাকলেও পরিবারের কারো মধ্যে নির্মমতা ঘটানোর মত সর্ম্পক কখনো ছিল না। ভাইদের মধ্যে সবসময় সুসম্পর্ক ছিল। ”
বেনু বলেন, “ রোকেনসহ অন্য ভাইদের সঙ্গেও প্রতিবেশী কারো সঙ্গে তেমনটা খারাপ কখনো দেখা যায়নি। নিহত মা ও ভাইয়ের স্ত্রী কারো সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক থাকার বিষয়টি কখনো জানাননি। ”
তবে ঘটনার পরিবারের কেউ নয়; বাইরের কেউ জড়িত থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন রোকেনের এ বড় বোন।
বাড়ীটিতে অবস্থানকারি মেজ বোন রমনা বড়–য়া গ্রেপ্তার ২ জন নিকটাত্মীয় ঘটনায় জড়িত ছিল কি, ছিল না; তা বলবেন কিভাবে মন্তব্য করে বলেন, “ তার ভাগিনী জামাই এ ঘটনা ঘটাতে পারে তা কল্পনায়ও আনা যাচ্ছে না। ”
রমনা বলেন, “ সেজ ভাই শিপুর স্ত্রী রিকু বড়ুয়া একটু ঝগড়াটে প্রকৃতির। স্বামী ও শ্বাশুরীসহ পরিবারের সবার সঙ্গে প্রায় সময় ছোটখাট বিষয় নিয়েও ঝগড়া করতো। সে হঠাৎ করে হাসে, আবার হঠাৎ করে রাগ দেখাতো। ”
এদিকে ঘটনার ব্যাপারে তেমনটা উল্লেখযোগ্য কাউকে সন্দেহ করতে পারছেন না মন্তব্য করেছেন ঘটনায় মা, স্ত্রী ও সন্তান হারানো কুয়েত প্রবাসী রোকেন বড়ুয়া।
তবে পুলিশসহ তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে তার সঙ্গে যাদের সামান্য যে অমিল বা বিরোধ রয়েছে তাদের নাম বলেছেন বলে জানান তিনি।
রোকেন বলেন, “ পুলিশ কিসের ভিত্তিতে ২ জন নিকটাত্মীয়কে গ্রেপ্তার করেছে তা তিনি অবগত নন। ঘটনায় তারা জড়িত ছিল কি, ছিল না; তাও বলা কষ্টকর। ”
তারপরও এ নিয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা ঘটনায় তদন্ত করে যাদের জড়িত প্রমান পান তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি স্বজন হারানো এ কুয়েত প্রবাসীর।
রোকেনের ভাষ্য মতে, ঘটনার দিন বিকাল সাড়ে ৫ টার দিকে স্ত্রী মিলাকে ফোন দিলে স্টেশনে (কোটবাজার) কেনাকাটা করছে বলে জানায়। তিনি ২৬ মিনিট তার সঙ্গে আলাপ করেন। গাড়ীতে ফোনে আলাপ করার এসময়ের মধ্যে মিলা বাড়ীতে ফেরেন।
বাড়ীতে পৌঁছার পর সন্ধ্যা ৭ টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ছেলে রবীন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়াশোনা শেষ করে। পরবর্তীতে স্ত্রী মিলাকে রাত ৯ টা ১৭ মিনিটের শ্বশুর শশাংক বড়ুয়া ফোন দিলে ভাল আছে বলে জানায়। এরপর রাত ১১ টা ৪০ মিনিটে রোকেনের ভাইয়েরা মিলাকে ফোন দিলে রিসিভ করেনি। পরদিন সকালে রোকেন দেশ থেকে ফোনে হত্যাকান্ডের খবর শোনতে পান।
রোকেন বলেন, হত্যাকারিরা কতটা পাশবিক তা ভাবতেই গা শিউরে উঠে। তার ছোট ২ টি সন্তান (ভাইয়ের মেয়েসহ), মা ও স্ত্রী একই কায়দা খুন করেছে।
“ হত্যাকারিরা স্ত্রীর শোয়ার কক্ষের আলমিরার একটি পার্ট (অংশ) খুলে নিত্য ব্যবহারের স্বর্ণের ২ জোড় কানের দুল ও ১ টি গলার চেইন লুট করে নিয়ে যায়। আলমিরাটির অন্য একটি অংশ ভাঙ্গতে খুবই চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। যেখানে ১০ ভরি স্বর্ণালংকার রক্ষিত ছিল। ”
তবে হত্যাকান্ডটি ডাকাতি নাকি শত্রুতামী তা ধারণা করতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেন এ কুয়েত প্রবাসী।

 

 

 

 

দেশব্যাপী আলোচিত চাঞ্চল্যকর এ হত্যা ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশের সদর দপ্তর ও পিবিআই এর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্তকাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করছে বলে মন্তব্য করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন।
আল-মামুন বলেন, ঘটনার পর থেকে পিবিআই এর কয়েকটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে ক্রাইমসিনগুলোর যেসব আলামত উদ্ধার করা সম্ভব তা সংগ্রহ করা হয়েছে।
“ সন্দেহের বাইরে কেউ নন। যারা এ ঘটনা সংঘটন করতে পারে তারা প্রত্যেকেই তদন্তের ক্ষেত্রে বিবেচনা বা নজরদারীর মধ্যে রয়েছে। আপাতত নির্দিষ্ট করে কাউকে জড়িত বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ নিয়ে আইসিটিসহ মাল্টিবোর্ড পদ্দতিতে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। ”
তবে নিহতদের ২ জন নিকটাত্মীয়কে যেহেতু জেলা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে; এ ঘটনায় তারা জড়িত কিনা তা চুড়ান্তভাবে আপাতত বলা সম্ভব হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন পিবিআই’র এ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
কোন কারণে ঘটনা ঘটেছে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয় মন্তব্য করে তদন্তকারি সংস্থাটির এ কর্মকর্তা বলেন, “ হত্যা ঘটনায় ডাকাতি, ব্যক্তিগত ও আত্মীয়তার সম্পর্কসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনা করা হচ্ছে। তদন্তে প্রত্যেকটা দিককে গুরুত্ব দিচ্ছি। এমন কি অপরিচিত লোক বা পেশাদার অপরাধের দিকটিও গুরুত্ব দিচ্ছি। ”
তবে অপরাধের প্রত্যেকটা দিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলেন আল-মামুন।
ঘটনায় সন্দেহাতিত একাধিক লোকজন জড়িত রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ হত্যাকান্ডটি সংঘটনের কালও রাত ১১ টার মধ্যেই। পারিপার্শ্বিক ও মানুষ্যের স্বাক্ষ্যে তা ধারণা করা যায়। ”
তবে এ ঘটনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করার জোর চেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং রহস্য উদঘাটন সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে পিবিআই এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আল-মামুন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •