কক্সবাজারে সুদখোর ও ক্ষুদ্রঋণের বেড়াজালে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী

 

শাহীন মাহমুদ রাসেলঃ

কক্সবাজার জেলার দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ এনজিও ও সুদখোর মহাজনের ঋণের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগণের বৃহৎ একটি অংশ নিজেদের আর্থিক দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা, এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। নিয়মিত ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ঋণ গ্রহীতার ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন।

ঋণ গ্রহণের সময় ঋণ প্রদানকারী ব্যক্তি বা সংস্থার সাথে এমন কিছু লিখিত শর্তে আবদ্ধ হন, যা ভঙ্গ করলে নেমে আসে কঠোর আইন। ঋণ গ্রহীতাদের প্রতিবাদ করার উপায় থাকে না।

দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিদেশ ফেরত ও বিভিন্ন কর্মসংস্থানমূলক প্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ হয়ে পড়ায় বেকারত্বের হার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নানাবিধ কারণে কৃষকদের দুরবস্থা বিরাজ করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। এ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় প্রতিটি পরিবারই এখন এক বা একাধিক এনজিও ঋণ কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন লোভনীয় কথা বলে এনজিও কর্মীরা দরিদ্র সাধারণ মানুষকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে। কিন্তু ঋণ গ্রহণের দু’এক সপ্তাহ পর থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।

 

 

 

যে সব উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেয়া হয় তা কতটুকু বাস্তবায়ন হলো তা দেখা হয় না। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেও এনজিওরা কিস্তিতে সময় দিতে নারাজ। তাছাড়া ঋণ নেয়ার পর মাত্র এক সপ্তাহ বাদে ঋণ আদায় শুরু হয়। এতে ঋণগ্রহীতারা টাকা কাজেও লাগাতে পারে না। এ অঞ্চলে এনজিও সুদের হার অত্যন্ত চড়া। কখনো তা শতকরা ২০ থেকে ৩০ টাকা। একজন কৃষক ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করলে সুদ-আসলে তাকে ৫২ কিস্তিতে ৫৭৭ টাকা হিসেবে বছরের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। ঋণের টাকা শোধ করতে যেয়ে অনেকেই সহায়-সম্বলহীন হতে হয়েছে।

জানা গোছে , অভারের কারণে এ জেলায় সর্বত্র শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ও বাড়ছে। বর্তমান সময়ে যে শিশুরা বাবা-মায়ের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শিক্ষাজীবনে পদার্পণ করার কথা, সে সব কোমলমতি শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই। সরজমিনে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রামু উপজেলার রশিদ নগর, জোয়ারিয়ানালা, কাউয়াখোপ, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, সদর উপজেলার পিএমখালী, ঝিলংজা, ঈদগাঁও, ইসলামপুর, জালালাবাদ, ভারুয়াখালী, চকরিয়া উপজেলার, রসুলাবাদ, পেকুয়া উপজেলাসহ মহেশখালী কুতুবদিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের ৭-১০ বছরের শিশুরাই কায়িক শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে।

পরিবারের অবহেলিত ও উপেক্ষিত এসব শিশুরা হোটেল-রেস্তোরাঁ, গ্যারেজ গাড়িতে চাকরি এমনকি রিকশা ভ্যান ও টমটম চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা গেছে। সারাদিনের ঘামঝরা পরিশ্রমের পরও এদের বেতন ৪০-৫০ টাকার মধ্যে। দারিদ্র্যক্লিষ্ট আসচ্ছল পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব নিতে গিয়েই মূলত বয়সের সাথে সামঞ্জস্যহীন শ্রম বিক্রি করতে হচ্ছে ভাগ্যবিড়ম্বিত শিশু শ্রমিকদের।

অনুসন্ধানে ভিন্ন কারণও খুঁজে পাওয়া গেছে। এ জেলার দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবন যাপন করা এবং অর্থনৈতিকভাবে দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারগুলোর রুটি-রুজির যোগান দিতেই মূলত শিশুশ্রমের জন্ম নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার এসব পরিবারের অনেকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাড়তি আয়ের লোভে শিশুদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শিশুশ্রম বিরোধী তৎপরতা না থাকায় ভাল-মন্দ বিচার করা যাচ্ছে না। প্রত্যন্ত এলাকার নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং স্কুলগুলোতে জবাবদিহিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় নিম্নআয়ের অশিক্ষিত লোকেরা দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে তাদের সন্তানদের শ্রম জগতে টেলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অপরদিকে জেলার নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। কর্মজীবী নারীরা কাজ করে সংসার চালায়।

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলায় ৬ হাজার স্বামী পরিত্যক্তা বিধবা ও দরিদ্র মহিলারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। অভাবের তাড়নায় জীবন বাঁচাতে এসব মহিলা সব কুৎসা, নিন্দা, মান-অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে জীবন সংগ্রামে নেমেছে। অনেকের স্বামীর অকাল মৃত্যুতে বিধবা হয়েছে। বহু তালাকপ্রাপ্তা মহিলারা স্বামীর অবিচারে ঘরে বসে অভিশপ্ত জীবন যাপন করছে। দরিদ্র ও অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে নারীরা কর্মের পথ বেছে নিয়েছে। কেউ ধান-চালের চাতালে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। কেউ শুটকির আড়ৎ, হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ করে চলেছে। অনেক মহিলা রাস্তার মাটি কেটে উপার্জন করে সংসার চালাচ্ছে। গ্রামের অনেক মহিলাই কৃষি কাজ করে যাচ্ছে।

 

 

 

জেলার কয়েকটি এনজিও কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে জানা যায়, ৭১টি ইউনিয়নে বিভিন্ন সংস্থার আওতায় প্রায় তিন হাজার নারী শ্রমিক মাটি কাটার কাজ করে সংসার চালায়। তবে এ কাজে পারিশ্রমিক হিসাবে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। মাটি কেটে পুরুষরা ৩/৫ শ টাকা পেলেও মহিলারা প্রায় ১০০ টাকা। রামু উপজেলার গর্জনিয়া গ্রামের মহিলা শ্রমিক রহিমা জানায়, আমরা সারাদিন পুরুষের মত মাটি কাটার কাজ করি অথচ মজুরী পাই পুরুষের অর্ধেক। বিধবা হিসেবে ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে আর কি কাজ করবো। এছাড়া যে আমাদের আর কোন উপায় নেই। আমরা যে কাজই করি, সে কাজেই আমাদের মজুরী নিয়ে প্রতারণা করা হয়। এদিকে সরকার বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করলেও প্রকৃত বিধবারা ভাতা পাচ্ছে না। সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় বরাদ্দকৃত ভাতার চাইতে বিধবা নারীর সংখ্যা বেশিতে সমস্যা হচ্ছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •