২০২১ সালের শুরুতে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হয়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। মূলত ওই বছরের এপ্রিল মাস থেকে বাড়তে শুরু করে চিনির দাম। সম্প্রতি সরকার কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে প্যাকেট চিনি ১১২ ও খোলা চিনি ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। অথচ বাজারে চিনির সংকট দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে খোলা চিনি ১১০ ও প্যাকেট চিনি ১১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়ে আসছে।
দাম বাড়ার কারণ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ছয় মাস ধরে চট্টগ্রামের বাজারে চিনির সংকট কাটছে না। ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে চিনির আমদানি কমেছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে চিনি পরিশোধনে খরচ বেড়েছে। ডলারের কারণে আমদানি শুল্ক বেড়েছে। তাই সবমিলিয়ে চিনির দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই।
তিন দফায় দাম বাড়লো ২৩ টাকা
গত বছরের অক্টোবর মাসে চিনির কেজিতে ৬ টাকা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। ওই সময় প্রতিকেজি প্যাকেট চিনি ৯৫ ও খোলা চিনি ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরের মাস নভেম্বরে কেজিতে ১২ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা আসে। তখন প্রতিকেজি প্যাকেট চিনি ১০৭ ও খোলা চিনি ১০২ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেয়া হয়। সবশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে এসে ৫ টাকা বাড়িয়ে প্রতিকেজি প্যাকেট চিনি ১১২ ও খোলা চিনি ১০৭ টাকায় বিক্রি করতে বলা হয়। গত তিন মাসে চিনির কেজিতে ৬, ১২ ও ৫ মোট ২৩ টাকা দাম বাড়ায় সরকার।
এর আগে গত বছরের আগস্ট মাসে প্যাকেট চিনি ৮৯ টাকা ও খোলা চিনি ৮৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এসে প্রতিকেজি খোলা চিনি ৯০ ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকায় বিক্রি করেছেন বিক্রেতারা।
তারও আগে ২০২১ সালের শুরুতে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয় চিনি। মূলত ওই বছরের এপ্রিলে এসে বাড়তে শুরু করে চিনির দাম। তখন কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকায় চিনি বিক্রির নির্দেশ দিয়েছিল সরকার।
তবে বার বার চিনির দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও তা মানেন নি বিক্রেতারা। উল্টো তারা মুনাফার আসায় চিনির সংকট দেখিয়ে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় চিনি বিক্রি করেছে। এখনো সে ধারায় হাঁটছে বিক্রেতারা। বরাবরের মত এবারো উধাও প্যাকেট চিনি। খাতুনগঞ্জেও প্রতিমণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮শ থেকে ৪ হাজার টাকায়।
আমদানি কমেছে অন্তত ২ লাখ টন
ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে চিনি আমদানিতে ভাটা পড়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭ লাখ ৩৪ হাজার টন চিনি আমদানি হয়। এর আগে গত অর্থবছরের একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন চিনি। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে গত বছরের তুলনায় ২ লাখ ৩৪ হাজার টন কম চিনি আমদানি হয়েছে।
পাশাপাশি গত দুই অর্থবছরে দফায় দফায় কমেছে চিনির আমদানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৭ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল প্রায় ২১ লাখ টন চিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৭ কোটি ৭১ লাখ ডলারের চিনি আমদানি হয়েছে। তার আগে গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল প্রায় ৪১ কোটি ডলারের চিনি।
খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ী ইসমাইল ট্রেডার্সের মালিক মো. রাজ্জাক সিভয়েসকে বলেন, বড় কিছু প্রতিষ্ঠান চিনি আমদানির জন্য অল্প পরিমাণে এলসি খুলতে পেরেছে। এ চিনি আসবে আরো দু মাস পর। তবে ছোট ছোট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতেই পারছে না। তার ওপর আমদানিকারক আমাদের দেশিয় মুদ্রায় পুরো টাকা শোধ করে দিলেও ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারককে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ডলার না পেয়ে সম্প্রতি বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো জাহাজ থেকে চিনি খালাসের অনুমতি দিচ্ছিল না। চিনিভর্তি কয়েকটি জাহাজ প্রায় দুমাস ধরে সাগরে ভেসেছিল। সবমিলিয়ে আমাদের চাহিদার তুলনায় চিনির সরবরাহ কম। তাই চিনির দাম বাড়তি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক সিভয়েসকে বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন ২ হাজার ৮শ বা তার চেয়ে বেশি কনটেইনার খালাস হচ্ছে। সব ধরনের পণ্যবাহী জাহাজ খালাস হয়ে গেছে। বন্দরে এখন কোন ধরনের জট নেই।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, বাজারে সবচেয়ে বেশি তেল-চিনির দামই বেড়েছে। আমাদের মোকামে চিনি আসলেও বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় আমাদের চিনি ব্যবসায়ীরা বাড়তি দরে চিনি কিনছেন। তাই মোকামেও চিনির দাম বাড়তি।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম সিভয়েসকে বলেন, বাজারে যেসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে তার পর্যাপ্ত আমদানির চেষ্টা অব্যাহত আছে। ডলার সংকটটাই আমদানিকারকদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। পণ্য আমদানির পর তা মজুদ না করে বাজারে ছেড়ে দিলে সাপ্লাই চেইনটা ঠিক থাকবে। পাশাপাশি রোজার আগে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে বেশি পণ্য যাতে না কেনেন। পাশাপাশি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাটাও জোরদার করতে হবে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন সিভয়েসকে বলেন, দিন শেষে আমরাও কিন্তু ভোক্তা। আমরা সব সময় দেখেছি সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনবারই তা মেনে চলেন নি। উল্টো তারা বাড়তি দরেই পণ্য বিক্রি করেছে। প্যাকেট চিনি বাজার থেকে উধাও। আসলে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা সংকট আর অজুহাত দেখিয়ে লাভ করতে চায়। কাজেই সামনে রোজা আসছে। এখন থেকেই বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনিছুজ্জামান সিভয়েসকে বলেন, আমাদের জনবল সীমিত। তবুও আমরা চেষ্টা করছি ভোক্তার ভোগান্তি কমাতে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।