এইচ এম নজরুল ইসলাম:
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে জানা যায়- “মে দিবসের সঙ্গে শ্রমিক অধিকারের সম্পর্কের সূত্রপাত হয় যুক্তরাষ্ট্রে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে। শিল্প বিপ্লব তখন পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ও দীর্ঘ কর্মঘণ্টার ফলে প্রতি বছরই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল হাজারো পুরুষ, নারী ও শিশু শ্রমিক।”
১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের এই দিন রাস্তায় নামেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা। আর এই শ্রমিকদের ওপর গুলি চলে। এতে ১০ জন নিহত হন। তাদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোট বিশ্বে ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি মেনে নেওয়া হয়। সেই থেকে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসাবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালন করে।
১৮৮৬ সালের পহেলা মে’র ঘটনার পর তো কত যুগ পেরিয়ে গেলো। কিন্তু এই পৃথিবীতে শ্রমিকদের অধিকার কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? ২০২৩ সালে এসে আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানাভাবে নানা মাত্রায় শ্রমিক শ্রেণি এখনো শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছে।
ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্রমিকদের এখনো লড়াই-সংগ্রামে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তবে সংগ্রামের অব্যাহত ধারায় শ্রমিকরা এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পের দিকে নজর দিলে উপলব্ধি করা যায় এখানে শ্রমিকরা কীভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। বঞ্চনার কারণে প্রায়ই গার্মেন্ট শিল্পে ধর্মঘট, জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুরের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।
কক্সবাজারের বৃহত্তর শ্রম সেক্টর বলতে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে হোটেল মোটেল জোনের প্রায় ৫ শতাধিক ছোট বড় হোটেল, গেস্ট হাউস,কটেজ এতে কর্মরত হয়েছে প্রায় ২০/৩০ হাজার শ্রমিক। তেমনি ৫/৬ শতাধিক রয়েছে রেস্টুরেন্ট সেখানে কর্মরত রয়েছে প্রায় ৩০/৩৫ হাজার শ্রমিক।
কিন্তু এতবড় শ্রমিক সেক্টরের কোন শ্রমিকদের দেওয়া হয়না নিয়োগপত্র।
ঈদ বোনাস কিংবা অতিরিক্ত শ্রম দিয়েও পায়না পর্যাপ্ত বেতন ভাতা সম্মানি।
মালিক পক্ষের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে ঘুম থেকে উঠে তার চাকরি থাকবে কিনা।
অনেকটা অনিশ্চিয়তার মাঝে ঠিকে আছে পর্যটন শিল্পে জড়িত প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক।
অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে এখনো লড়াই করতে হচ্ছে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের জন্য পর্যাপ্ত বেতন বোনাস আর নিয়োগপত্র পাওয়ার জন্য ।
আর শ্রমিকদের বঞ্চনার জন্য কোনো কোনো মালিক যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী একশ্রেণির শ্রমিক নেতাও। আবার দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রয়েছে বিদেশি ষড়যন্ত্রও। এসব নানা কারণে দেশের বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিক ও মালিকের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিল্পে শ্রমিক-মালিকের ন্যায্য স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার ব্যাপারে নানা তত্ত্বের দায়ও কম নয়।
দেশীয় শ্রম বাজারে আরেকটি মহা সংকট দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে কক্সবাজারের প্রতিটি সেক্টরে শ্রম বাজার দখল করে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা।
যার ফলে একদিকে যেমন আমার দেশের খেটে খাওয়া দিনমজুর গুলো তাদের শ্রম দেওয়ার ঠিকানা হারাচ্ছে তেমনি রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন শ্রম বাজারে কাজের সুযোগ দিয়ে শ্রমের ন্যার্য মূল্যও হারাচ্ছে স্থানীয়রা।
তার অন্যতম কারন সস্তায় পাওয়া যায় রোহিঙ্গা শ্রমিক! দেশের শ্রম বাজার যেন রোহিঙ্গারা এসে দখল করতে না পারে তার জন্য অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ এখনি গ্রহণ করা না গেলে স্থানীয়দের মধ্যে বেকারত্ব বাড়তে পারে তা বলা যায় নিশ্চিন্তে।
যে শ্রমিকের শ্রম মেধায় মানব সভ্যতার বিকাশ, উত্থান ও মালিকদের বিত্ত-বৈভব, সেই শ্রমিককে ঝুকির মাঝে ফেলে ছাঁটাই করে, অর্ধাহারে অনাহারে রেখে, মে দিবসের মর্যাদা রক্ষা করা যায় না। আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই হয়তো তিনি উপলব্ধি করে বলেছিলেন পৃথিবী আজ দুই ভাবে বিভক্ত একদিকে শোষক অন্যদিকে শোষিত। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতার উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবং আইএলও-র ৬টি কোর কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এটি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের অধিকার রক্ষায় এক অনন্য মাইলফলক। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সকলকে দলমত নির্বিশেষে একাত্ম হতে হবে। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে শ্রমিক-মালিক সম্প্রতি দেশের উন্নয়নের পথকে তরান্বিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক এইচ এম নজরুল ইসলাম
সদস্য সচিব বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)
কক্সবাজার জেলা শাখা