রামুতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আড়ালে হুন্ডি ও চোরাচালান ব্যবসা

 

হাসান তারেক মুকিম,রামু

কক্সবাজারের রামুর কচ্ছপিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়িতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আড়ালে চলছে রমরমা হুন্ডি ব্যবসা। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রতিদিন অবাধে আসছে গরু, সুপারি, মাদকসহ বিভিন্ন পন্য। বর্তমানে এ ব্যবসার প্রধান মাধ্যমে অবর্তীণ হয়েছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শাখাগুলো। ব্যাবসায়ীরা এজেন্ট ব্যাংকিং শাখায় টাকা জমা করলেই চাহিদা মত মিয়ানমার থেকে চলে আসছে গরু, সুপারি সহ যাবতীয় মালামাল। একই সাথে হন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। 

এদিকে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে হুন্ডি ব্যাবসা করেই অনেকে রাতারাতি বনে গেছে বিত্তশালী।

জানা যায়, রামুর কচ্ছপিয়ায় গর্জনিয়া বাজারে অবস্থিত আল আরাফা এজেন্ট ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক এজেন্ট ও নাইক্ষ্যংছড়ির ব্যাংক এশিয়া এজেন্ট ব্যাংক সহ বিভিন্ন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আড়ালে চালানো হচ্ছে চোরাচালান ও একই সাথে হুন্ডি ব্যবসা। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিদিন মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে অন্ত্যত শতকোটি টাকা। সীমান্তে নগদ টাকা বহন করতে ঝুঁকি থাকায় চোরাচালানকারীরা এজেন্ট ব্যাংকেই নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে।

 

সুত্রে জানা যায়, কচ্ছপিয়ার গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির এজেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিনে কিছু ব্যবসায়ী সীমান্তের ঐ পারে মিয়ানমারে অবস্তান করেন। তারা সেখানে মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের সাথে সমন্বয় করে চোরাই পথে গরু, সুপারি, সিগারেট, মাদক সহ বিভিন্ন পন্য বাংলাদেশে সরবরাহ করেন। পরে বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের হাতে সমুদয় টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আসেন এজেন্ট ব্যাংকের লোকজন। অথবা রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা নিজেরাই এসে গর্জনিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ির এজেন্ট শাখা থেকে টাকা বুঝে নেন। এসব অবৈধ কারবার চলতে থাকায় রাজস্ব আয় ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

 

রামু উপজেলার ব্যবসায়ী মোঃ ইলিয়াছ (ছদ্মনাম) জানান, মিয়ানমার থেকে গরু আনতে পাচারকারীদের সঙ্গে টাকা পাঠাতে অনেক ঝুঁকি নিতে হতো। অনেকে টাকা মেরেও দিয়েছে। এরপর থেকে এজেন্ট ব্যাংক শাখায় হুন্ডির মাধ্যমেই টাকা পাঠাতে থাকেন। এ মাধ্যমে টাকা লেনদেনে এ পর্যন্ত কোন সমস্যায়ও পড়তে হয়নি তাকে। 

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত ১০ জন গরু ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, গর্জনিয়া বাজারে আল আরাফা এজেন্ট ব্যাংকের স্বত্বাধিকারী কচ্ছপিয়ার হাজির পাড়া এলাকার মৌলভী দিল মোহাম্মদের পুত্র মোঃ আলম, ব্র্যাক ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকের স্বত্বাধিকারী বালুবাসা এলাকার নুরুল আলমের পুত্র কলিম উল্লাহ, ব্যাংক এশিয়া এজেন্ট ব্যাংকের স্বত্বাধিকারী ফরমান উল্লাহ ও মুদির দোকানদার তুলাতলি এলাকার মোঃ পেঠান এর পুত্র মোঃ হোছেন এর   হাতে টাকা দিলেই মিয়ানমার থেকে গরু চলে আসে বাংলাদেশে। হুন্ডি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শতাধিক গরু ব্যবসায়ী প্রতিদিন কোটি কেটি টাকা মিয়ানমারে পাঠান বলে জানান এসব ব্যবসায়ীরা। আল আরাফা এজেন্ট ব্যাংকের স্বত্বাধিকারী মোঃ আলমের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয়। প্রতিদিন ৪-৫ কোটি টাকা লেনদেন হয় তার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আড়ালে। 

এক গরু ব্যবসায়ী বলেন, গরু আনতে মিয়ানমারে নগদ টাকা পাঠাতে অনেক ঝুঁকি আছে। এখন উল্লেখিত এজেন্ট ব্যাংক শাখার মালিকদের হাতে টাকা দিলে দিলে গরু চলে আসে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে থাকা তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পৌঁছে দেন গর্জনিয়া বাজার পর্যন্ত। কমিশন বেশি দিলে তাদের মাধ্যমে বাকিতেও গরু আনা যায়। পরে সেই গরু বিক্রি করে এজেন্ট ব্যাংকে ওই টাকা বুঝিয়ে দিলেই হয়ে যায়।

জানা গেছে, চোরাচালানের রোড হিসাবে পরিচিত নাইক্ষ্যংছড়ির ফুলতলি, ভালুক্কায়া, বাইশারী, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, বম্বনিয়া এবং রামুর হাজিরপাড়া, মৌলভীরকাটার বেশ কিছু চোরাকারবারি ও স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিকে সঙ্গে নিয়ে এই অবৈধ বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছেন এজেন্ট ব্যাংকিং মালিকগন। এতে করে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব যেমন হারাচ্ছে, ঠিক তেমনি মাদক বিস্তারের সুযোগও তৈরি করেছে এই চক্রটি। এই চক্রে জড়িত আছে নাইক্ষ্যংছড়ি, গর্জনিয়া-কচ্ছপিয়ার অন্তত ১০ হুন্ডি ব্যবসায়ী। 

হুন্ডির মাধ্যমে কোটি টাকা মিয়ানমারে পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে আল আরাফা এজেন্ট ব্যাংকের স্বত্বাধিকারী মোঃ আলম অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, টাকা সংগ্রহের পর ব্যাংক আইন মেনে টাকা পোস্টিং করার পর সাথে সাথে গ্রাহকের কাছে রশিদ দিয়ে দেন। এছাড়া টাকা জমা দিলে মিয়ানমারের গরু চলে আসার বিষয়টি তিনি মিথ্যা বলে দাবি করেন। 

একইভাবে ব্র্যাক ব্যাংক এজেন্টের মালিক কলিম উল্লাহ, নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাংক এশিয়া এজেন্টের স্বত্বাধিকারী ফরমান উল্লাহ ও মুদির দোকানদার মোঃ হোছেন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

রামু থানার অফিসার ইনচার্জ আবু তাহের দেওয়ান বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে টাকা পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। যাচাই-বাছাই করে সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।  

জানতে চাইলে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মুস্তফা বলেন, ডিসি মহোদয়ের নির্দেশক্রমে ইতিমধ্যে এজেন্ট ব্যাংকের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলমান। পরবর্তীতে এজেন্ট ব্যাংক পরিচালকদের নিয়ে একটি অবহিতকরণ সভার মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপর তাদেরকে গাইডলাইন দেয়া হবে। পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকের আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের ব্যাপারে সুনিদ্রিস্ট অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আড়ালে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সনাক্ত করে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা গেলে চোরাচালানকেন্দ্রিক অনেক অবৈধ বাণিজ্যের হিসাব মিলবে বলেও মত সংশ্লিষ্টদের।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •