রামু বৌদ্ধ মন্দির হামলার এক যুগ: এখনই সময়-পুনঃতদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার

 

মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান:

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের রাতটি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এক গাঢ় কালিমা হয়ে রয়ে গেছে। সেদিন কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় সংঘটিত হয়েছিল একটি বর্বর, হৃদয়বিদারক ও লজ্জাজনক ঘটনা—যেখানে ধর্মের নামে উন্মত্ত একদল মানুষের হাতে ধ্বংস হয়েছিল শতাব্দীপ্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির, পুড়ে ছাই হয়েছিল বুদ্ধমূর্তি, ধর্মীয় নিদর্শন ও নিরীহ মানুষের আবাসভূমি।

একটি মিথ্যা ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া গুজবের জেরে ঘটে যায় এ নারকীয় হামলা। পরে তদন্তে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো সেই তথাকথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মূল লক্ষ্য ছিল রামুর সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হামলা চালানো এবং ভীতি সৃষ্টি করা।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এক যুগ পার হলেও এখনো এই ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। মামলার চার্জশিট এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে প্রকৃত অপরাধীরা রেহাই পেতে পারে—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই উঠে আসছে। তদন্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বিচারহীনতার এক চিরচেনা চিত্রকেই আবারও সামনে এনেছে। এই পরিস্থিতি আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

রামুর কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত শীলপ্রিয় মহাথের বলেন, “হামলার ঘটনার বিচার আজও ঝুলে আছে। দূর্বল চার্জশিটের কারণে তা কখনো শেষ হবে বলেও মনে হয় না। এ মামলার পুনঃতদন্ত হোক, নতুন করে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হোক। প্রকৃত অপরাধীরা যেন চিহ্নিত হয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়—এই আমাদের প্রত্যাশা।”

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবু মিথুন বড়ুয়া বোথাম স্মরণ করিয়ে দেন সংবিধানের ভিত্তি: “বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সংবিধান ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু যখন সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, যখন ন্যায়বিচার বিলম্বিত হয় বা প্রভাবিত হয়, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক দায় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।”

রামুর ঘটনা কেবল একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নয়, এটি ছিল মানবতা, সহনশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার উপর এক সরাসরি আঘাত। এই কলঙ্কময় অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের উচিত এখনই সেই ভুল শুধরে নেওয়া। সময় এসেছে, যখন পুরনো তদন্ত ও চার্জশিটের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নতুনভাবে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত শুরু করতে হবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে—যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর ধর্মীয় বিভেদের নামে সহিংসতা চালাতে সাহস না পায়।

ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত শান্তি আসে না। আর শান্তি ছাড়া একটি সমাজ কখনোই সত্যিকারের সভ্য ও মানবিক হতে পারে না।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •