ছোট্ট গাম্বিয়াকে বড় অভিনন্দন : রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

শক্তির চেয়ে সদিচ্ছার মূল্য গুণগত অর্থে বেশি। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে পশ্চিম আফ্রিকার ছোটখাটো দেশ গাম্বিযার ভূমিকা এ সত্যটিই আজ প্রমাণ করেছে। গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী তাদের ভূমিকার যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের যে রূঢ় সত্যটি বলেছেন, তা সবারই মনের কথা। বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর এ ব্যাপারে উদাসীন ভূমিকা বা নীরবতার বিপক্ষে সমালোচনা মানবিক চেতনার মানুষ মাত্রেরই।

বিশ শতকে বিশ্বশান্তির প্রবক্তা রঁলা, রাসেল, বার্বুস, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষীর এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বক্তব্য ভিন্ন ছিল না; যেমন- গণতন্ত্রী স্পেনে ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য। এদের মূল কথা ছিল, এমন নির্মমতায় ‘নীরবতার অর্থ পাপ’। তখনও অসহায় স্পেনকে রক্ষা করতে ইঙ্গ-মার্কিন মিত্র শক্তি নীরব ভূমিকা পালন করে।

আজ ২০১৯ সালে পৌঁছে গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী ওই কথাটিই নতুন করে আমাদের জানালেন, ‘মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধে বিশ্ব ব্যর্থ হওয়ায় গাম্বিয়াকে আন্তর্জাতিক আদালতে আসতে হয়েছে।’ হল্যান্ডের (নেদারল্যান্ডস) রাজধানী হেগের শান্তি প্রাসাদে এ উপলক্ষে যে মানবিক শব্দধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে, তা বহু শ্রুত ‘গণহত্যা বন্ধ কর’ (স্টপ জেনোসাইড)। এ শব্দধ্বনি আমরা শুনেছি ১৯৭১-এ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক সংঘটিত বাঙালি গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে।

বিশ্ব মাঝেমধ্যে ঘাতক শক্তির হাতে পীড়িত-ধর্ষিত হয়। গণহত্যায় মাটি রক্তে রঞ্জিত হয়। বিশ্ব রাজনীতি তখন প্রায়ই তার আপন স্বার্থের পথ ধরে চলে, মানবিক চেতনা ও শান্তির বোধ বড় হয়ে ওঠে না। একাত্তরে আমরা অংশত এমন ঘটনা লক্ষ্য করেছি। দেখেছি, রুয়ান্ডায় যুক্ত সার্বিয়ায় কিংবা ইয়েমেনে ও আরও একাধিক দেশে। বিশ্বের শক্তিমান বিবেক এসব ক্ষেত্রে সময়মতো সাড়া দিতে পারেনি। কখনও দিয়েছে, পরে রক্তপাতের নির্মমতা শেষে।

রোহিঙ্গা গণহত্যার ক্ষেত্রে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ‘নীরবতার পাপের’ কারণে মিয়ানমারের সামরিক শাসক এবং শান্তির নোবেল পুরস্কারে ধন্য অং সান সু চি তাদের অমানবিক কার্যকলাপ চালাতে পেরেছেন অসহায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নর-নারী আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে। বাকিদের প্রাণ সুতার ওপর ঝুলছে।

একই কারণে মিয়ানমারের উদ্ধত ভূমিকা জাতিসংঘের অনুসন্ধানী গ্রুপকে রাখাইনে ঢুকতে না দেওয়ার, শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে টালবাহানা ও মিথ্যাচার, রোহিঙ্গাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আবাসন স্থানগুলোকে বিরান ভূমিতে পরিণত করার মতো নির্মম ও জঘন্য কাণ্ড ঘটানো সম্ভব হয়েছে।

রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করা ও শরণার্থী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঝুলিয়ে রাখার কাজটি মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী সহজেই করতে পেরেছে বিশ্বশক্তির নীরবতার কারণে। বিস্ময়কর ঘটনা হলো, গণতন্ত্র ও শান্তির স্লোগানধারী অং সান সু চিও শাসন ক্ষমতার লোভে সামরিক জান্তার সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়ানো।

ক্ষমতা এমনই আকর্ষণীয় শক্তি যে, এর জন্য সব আদর্শ বিসর্জন দেওয়া যায়। গণতন্ত্র ও শান্তির প্রবক্তা হয়ে সুখ্যাতি অর্জনের পর ইঙ্গ-মার্কিন রাজনৈতিক-কূটনৈতিক চালে সু চির প্রতিষ্ঠা মিয়ানমারের শাসকশ্রেণিতে। নেপথ্য স্বার্থ ছিল ইঙ্গ-মার্কিন লবির। যে জন্য তাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার ব্যবস্থা শক্তির এসব খেলা নতুন কিছু নয়, বলতে হয় পুরোনো ইতিহাস দেশে দেশে।

দুই .

কিন্তু লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিয়ে মাসের পর মাস মিয়ানমারের প্রতারণা, প্রত্যাবাসনে নানা উপলক্ষে বাধা সৃষ্টি, জাতিসংঘকে উপদ্রুত অঞ্চলে প্রবেশ করতে না দেওয়া, সর্বোপরি এসব ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মানসপুত্রী সু চির বিস্ময়কর নীরবতা, ক্ষেত্রবিশেষে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পক্ষ সমর্থনের কারণেই সম্ভবত বোধোদয় ঘটে ওআইসির।

শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বীকৃতি বিশ্বের একাংশে। হয়তো তাদের সামনে এমন রাজনৈতিক চাতুর্যের ঘটনাও স্পষ্ট ছিল যে, চীন রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে একমত হয়ে সমস্যা সমাধানের সমর্থ জানিয়েও বাস্তবে কোনো ভূমিকা নেবে না। অগত্যা হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের শরণাপন্ন হওয়া।

ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। কিন্তু বলিষ্ঠ তাদের ভূমিকা; ইতিবাচক ও মানবতাবাদী তাদের ভূমিকা। হেগের বিচারপতিদের সামনে গণহত্যার যেসব আলামত তুলে ধরা হলো, তাতে তাই মনে হয়। তাদের দাবি, অবিলম্বে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হোক আদালতের পক্ষ থেকে। মিয়ানমারে অবস্থানরত কয়েক লাখ রোহিঙ্গার পক্ষে তাদের এ আবেদন।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রসহ সর্বমহলে বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করলেও প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের শক্তিমান দেশগুলোতে এদিক থেকে সুনমান নীরবতা। কারণ, তারা জানে হেগ বিচারালয় বিষয়টির নৈতিক দিকনির্দেশনা দিলেও নিষ্পত্তির বাস্তবায়নে ইতিবাচক কিছু করতে পারবেন না। তাদের ও বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মর্জির ওপর। সেখানকার ‘ভেটো’ সব ওলটপালট করে দিতে পারে। যেমন করেছিল সোভিয়েত ভেটো একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে।

তিন .

যেমনটি আশঙ্কা করা গিয়েছিল যে, হেগ আদালতে গণতন্ত্রী নামে পরিচিত সু চির ভূমিকা তেমনটিই দেখা গেল। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান বাংলাদেশের জন্য এবং তাদের ঠিকই দেখা গেল, সু চির মিয়ানমারের পক্ষে আত্মরক্ষা সমর্থনে বাস্তব সত্য অস্বীকার। জাতিসংঘ যেখানে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করছে, সু চি সেখানে তার বক্তব্যে বলছেন, ‘অপরাধ কিছু হয়েছে, তবে তা গণহত্যা নয়।’

তিনি সব ঘটনার দায় স্বাধীন আরাকানের স্লোগান তোলা বিদ্রোহী রোহিঙ্গা তরুণদের ওপর চাপিয়েছেন। তার মতে, এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভিযান চালিয়েছে, আর তাতে কিছু আতিশয্য ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গা নর-নারী, শিশু হত্যা ও ব্যাপক নারী ধর্ষণের ভয়াবহতার কথা বেমালুম অস্বীকার করে গেছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া একজন শান্তিবাদী নারীর চমকপ্রদ আচরণ!

মিয়ানমারে একাধিক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, যারা খুবই সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা পীড়িত, নির্যাতিত। তাই মিয়ানমার সরকারের ওই হিটলারি নীতির কারণে কারেন বিদ্রোহীরা অনেক আগেই শাসনের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেও কিছু করে উঠতে পারেনি কঠোর-নির্মম সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গা তারুণ্যের বিদ্রোহী ভূমিকা তো অনেক পরের ঘটনা।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সু চির বক্তব্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়ার এবং তাদের রাখাইনে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ অবস্থান সম্বন্ধে কোনো আভাস-ইঙ্গিত নেই। এ ভূমিকার তাৎপর্যটি কী? তা হলো, তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার পক্ষে, ‘এথ্‌নিক ক্লিনজিং’-এর পক্ষে। আরাকানের প্রাচীন সীমানা নিয়ে এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ নির্ধারিত সীমানা নিয়ে তার বক্তব্য থেকেও তার অন্তর্নিহিত মনোভাব বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। তিনি চট্টগ্রামে সমুদ্র সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চল আরাকান হিসেবেই চিহ্নিত করতে চান। অর্থাৎ যে রোহিঙ্গারা গেছে, ওটা তাদেরই একদা ভূখণ্ড। কাজেই ওরা সেখানেই থাকুক, এমন এক ধরনের চিন্তা তার বক্তব্যে পরোক্ষে প্রকাশ পেয়েছে। এ বক্তব্য থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের অবশেষ মনোভাব বুঝে নিতে পারি। আর এটাও ঠিক যে, আজ (১২.১২.২০১৯) হেগ আদালতে দুই পক্ষের শুনানি আমাদের কোনো বাঞ্ছিত বিন্দুতে পৌঁছে দেবে না।

তবে পূর্বোক্ত নৈতিক জয়-পরাজয়ের যে কথা ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, তারও ভালোমন্দ অনেকটা নির্ভর করবে আদালতের রায়ের ওপর। তারা যদি অন্তর্বর্তীকালীন কোনো ব্যবস্থার নির্দেশ দেন, তা অবশ্যই ইতিবাচক বিবেচিত হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু এ মামলা থেকে বাংলাদেশের পক্ষে আশা করা ঠিক হবে না। তবে মিয়ানমারকে যে বিশ্ব আদালতে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে এবং গণহত্যার বিষয়টিকে মামলার উপযোগী বলে আদালত গ্রহণ করেছেন, এটাও এক ইতিবাচক প্রাপ্তি।

তাই বলে বাংলাদেশকে নিশ্চেষ্ট বসে থাকলে চলবে না। তাদের কূটনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক তৎপরতা সচল রাখতে হবে। সর্বোপরি এ সমস্যার বড় চাবিকাঠি রয়েছে যে চীনের হাতে, আমরা আগের মতো আবারও বলি, সেই চীনকে দিয়েই এ কাঁটা তুলতে হবে লাগাতার কূটনৈতিক তৎপরতায়। চীন নানাভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত; যেমন পণ্যবাজারে, তেমনি বিনিয়োগে। সে সূত্র ধরেই চীনকে চাবি ঘোরাতে রাজি করাতে হবে। সদিচ্ছা নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম, শেষ কথাও তাই। কথা ও কাজে সদিচ্ছার প্রকাশ চাই মিয়ানমার ও চীনের পক্ষ থেকে।

ভাষাসংগ্রমী, রবীন্দ্র গবেষক
প্রাবন্ধিক ও কবি

  •  
  •  
  •  
  •  
  •