নিবেদিত একজন শিক্ষাগুরুর প্রস্থান

আব্দুল কুদ্দুস রানা:

বিকাল চারটা।আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা। একটু পরেই বৃষ্টি নামতে পারে।উত্তরের শীতল হাওয়ায় সবুজ গাছপালাগুলো দুলছিল।
মহাসড়কের পূর্বপাশে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্টান ‘কক্সবাজার সরকারি কলেজ’।দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসের এক পাশে বিশাল ফুটবল খেলার মাঠ।মাঠের তিনভাগ আর গ্যালারিতে বসা অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী।তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষও। সবার দৃষ্টি বিজ্ঞান ভবনের সামনে তৈরি মুক্তমঞ্চের দিকে।মঞ্চে দাঁড়িয়ে তখন বিদায়ভাষণ দিচ্ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর একেএম ফজলুল করিম চৌধুরী।এই ৩০ জুন তাঁর চাকরিজীবনের অবসান দিবস।তার আগেই এই গণসংবর্ধনার আয়োজন।

বৈরী পরিবেশে নিবেদিত একজন শিক্ষাগুরুর এমন বিদায়-বিশ্বাস করতে পারছিলনা উপস্থিত শিক্ষার্থীরা। কলেজে বর্তমানে ১৩টি সম্মান কোর্সসহ ১৪টি বিভাগে পড়ছে ১৩ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী। প্রিয় শিক্ষককে বিদায় জানাতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সাগর-নদী-পাহাড় পেরিয়ে ছুটে আসে ক্যাম্পাসে।বিদায়ের করুণ সূরে সবার অন্তর ভারাক্রান্ত, বিষন্নতায় আচ্ছন্ন তাদের হৃদয় মন।হাজারো চোখ সিক্ত অশ্রু-জলে।

বক্তব্যের একেবারে শেষ মুহুর্তে প্রিয়শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল করিম চৌধুরীর বাণী, তোমাদের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ-‘ভালো করে লেখাপড়া শিখে মানুষ হও। আত্মনির্ভলশীল এবং আত্মপ্রত্যয়ি মানুষ হও।সৃজনশীল সৃষ্টিশীল সৎ মানুষ হও। দেশপ্রেমিক মানুষ হও, দেশ-জাতি উপকৃত হবে। মানুষ তোমাদের মনে রাখবে’।

অনুষ্টান শেষ। শিক্ষার্থীরা স্যারকে ঘিরে ধরলো। পা ছুঁয়ে সালাম করতে করতে কেউ কেউ শুরু করলো কান্নাকাটি। প্রিয় স্যারের সাথে মুঠোফোনে সেলফি তুলতেও ভুলছেনা অনেকে। এমন বিদায় ক‘জনার হয়?

অধ্যক্ষ স্যার তাঁর প্রিয়শিক্ষার্থীদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবার বললেন, ‘সৃজনশীল-আলোকিত মানুষ হও, পৃথিবী তোমাদের মনে রাখবে’।
সন্ধ্যার আগে সবাইকে রেখে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলেন প্রিয় অধ্যক্ষ স্যার। এটা তাঁর অবসরজনিত বিদায়। স্যারের বিদায়ে হতবাক শিক্ষার্থীরা । শেষ মূহুর্তে হতাশ মনে সবার রওয়ানা বাড়ির পথে, পেছন পড়ে আছে স্মৃতির ফাঁকা ক্যাম্পাস। যেখানে চলছে অদ্ভুত এক নীরবতা।
#
এতক্ষণ ধরে শিক্ষাগুরুর গণসংবর্ধনার যে বর্ণনা আপনারা পড়লেন, তা ছিল কাল্পনিক। করোনাকাল না হলে অধ্যক্ষ স্যারের বিদায় অনুষ্টানটা ঠিক এরকমই হতো বলে আমার বিশ্বাস।
শুধুই কি কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁকে বিদায়সংবর্ধনা দিতেন ? মোটেও না। কক্সবাজার শহরের আনাছে কানাছে বিদায় সংবর্ধনার ধুম পড়ে যেত। কারণ এই মানুষটা কক্সবাজারের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের প্রাণ ছুঁতে পেরেছিলেন।
তাই তাঁর বিদায়দিনে শ্রেণিপেশার মানুষ চুপ মেরে বসে থাকতেন না। কিন্তু করোনাকাল সেটা হতে দিল না। স্যারও দেখতে পেলেন না-তা্ঁর প্রতি কক্সবাজারের মানুষের টান কতটুকু ? এটা তাঁর অবসরকালীন জীবনে বড় অপ্রাপ্তি হিসাবেই থেকে যাবে।

# শিক্ষাগুরুর নিরব প্রস্থান
বিদায় কয়েক রকমের হয়। ক্ষণিক দেখার পর বিদায়, প্রিয়জনের মন থেকে বিদায়, কর্মজীবন শেষে বিদায় এবং চিরবিদায়। প্রতিটা বিদায়ের পেছনে কিছু না কিছু স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। যেমন, প্রিয়জন মন থেকে বিদায় নিলে জীবনে সঙ্গী হয় দু:খ-কষ্ট আর বেদনা।

অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল করিম চৌধুরীকে নিয়েও আমার অনেক স্মৃতি।কক্সবাজারে আসার পর থেকেই তাঁর সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। তিনি আমাকে পড়াননি, তবুও তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করি। বয়সে তিনি আমার অনেক বড়, কিন্তু সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তিনি আমাকে ডাকেন ‘রানা সাহেব’ নামে। সময় পেলেই তিনি আমার অফিসে ( প্রথম আলো অফিসে) ছুটে আসেন, নতুবা আমাকে তাঁর অফিসে যেতে হয়।এমন একজন মানুষের বিদায় ১৬৪৮ শব্দের গাঁথুনিতে শেষ হবে ভাবতে পারছিনা। করোনাকাল সবকিছু উলট-পালট করে দিলো।

আগামি ৩০ জুন প্রফেসর একেএম ফজলুল করিম চৌধুরীর অধ্যক্ষ পদে চাকরির শেষ কর্মদিবস।এরপর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অবসান। তিনি এ কলেজে যোগ দেন ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল। ৩০ জুন পযন্ত এ কলেজে তিনি সময় দিয়েছেন দীর্ঘ ৭ বছর ২ মাস ১৫ দিন।এসময়ে তিনি কলেজের উন্নয়নে যথেষ্ট ভুমিকা রাখেন। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন কলেজ ক্যাম্পাস।

ইতিমধ্যে ৬০ লাখ টাকায় বাণিজ্য ভবনের উর্ধমূখি সম্প্রসারণ (দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা) হয়েছে। ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকায় নির্মিত হয়েছে ছয়তলা বিশিষ্ট শেখ হাসিনা ছাত্রী নিবাস। ৫ কোটি ৩১ লাখ টাকায় হয়েছে নতুন একাডেমিক ভবন। বিজ্ঞান ভবন, জীববিদ্যাভবন দুইতলা থেকে উন্নিত হয়েছে চারতলায়।শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হয়েছে শিক্ষক পরিষদ মিলনায়তন। বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ধ্যানজ্ঞান প্রসারে হয়েছে বিজ্ঞান ক্লাব।শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চর্চার জন্য তৈরি হয়েছে বিজ্ঞান চত্বর।
২০১২ সালে বাংলাদেশে বিলুপ্ত ঘটে তালিপাম্প গাছের। এরকম দুর্লভ একটি গাছের চারা রোপন করে কলেজের সম্মুখে তৈরি হয় তালিপাম্প চত্বর। এর পশ্চিম পাশে পাম্প চত্বর। সেখানে লাগানো হয় পাম্প গাছ।

আমাদের আমলে কলেজে বাস ছিল একটি। অধ্যক্ষ ফজলুল করিম চৌধুরীর যোগদানের পর যুক্ত হয় আরও দুটি বাস। একটি ২০১৬ সালে উপহারস্বরূপ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরেকটি দিয়েছে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর, ২০১৯ সালে।
ক্যাম্পাসে পুরনো যে মসজিদ-তার দৃষ্টিনন্দন কাজটুকুও হয়েছে এই লোকটার হাতে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তিনি।মুসল্লিদের অজু করার জন্য মসজিদের পাশে তৈরি করে দেন অজুখানা।

বৃষ্টি হলে মাঠে জমে যায় হাঁটু পানি, তখন ফুটবল খেলা যায়না। বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহযোগিতায় তিনি সংস্কার করলেন সেই মাঠ। এখন সেই মাঠে সবসময় খেলাধুলা চলে। বসেবসে খেলাধুলা উপভোগের জন্য মাঠে তৈরি হয় মিনি গ্যালারি।শিক্ষার্থীদের পানীয় জলের সংকট নিরসনে ক্যাম্পাসে বসানো হয় বিশুদ্ধ পানির ফোয়ারা।
শিক্ষার্থীদের টাকা লেনদেন সুবিধার জন্য ক্যাম্পাসে স্থাপন করা হয় বেসিক ব্যাংকের একটি শাখা। স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিতকরণে রয়েছে ক্যান্টিন ফুড কর্ণার।বিজ্ঞান ভবনের সামনে স্থাপন করা হয় ইটপাথরের স্থায়ী মুক্তমঞ্চ। সেই মঞ্চে চলে আড্ডা-আলোচনা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনোদনমূলক কর্মকান্ড।

কলেজের জায়গা-জমি দখল করে তৈরি হবে সড়ক-আবাসন প্রকল্প। দখলবাজদের পক্ষে সবাই চুপ। কিন্তু চুপ থাকতে পারেননি এই মানুষটি। চুপ থাকার বিপরীতে অফারও আসে মোটা অংকের। নির্লোভ প্রিন্সিপাল মুহুর্তে না করে দিলেন। দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা টুকে দিলেন আদালতে।রক্ষা পেল কলেজের কয়েক কোটি টাকার মূল্যবান সম্পদ।

শিক্ষার্থীরা ময়লা আবর্জনা ফেলে নোংরা করে ক্যাম্পাস। আর অধ্যক্ষ সাহেব হেঁটে হেঁটে সে ময়লা নিজ হাতে তুলে নেন।শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিসে না বসে তিনি প্রায় সময় সাধারণ চেয়ার নিয়ে বসতেন বাইরে, রাস্তায় কিংবা গাছের ছায়াতলে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের ( শিক্ষার্থীদের) ডেকে বলতেন-‘ বাজি, ইক্যা আইও। লেহা পড়া ঠিকমত গরর নে ? হন সমস্যা আছে নে ?

আর এই কারণেই তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠেন বাবার মতো, শিক্ষকের চেয়েও একটু বেশি বন্ধুসুলভ, খাটি একজন মানুষ রূপে।সকল শিক্ষার্থীদের তিনি সন্তানের মত আগলে রাখতেন।প্রতিদিন বিকাল বেলায় হোস্টেলে গিয়ে ছাত্রীদের খোঁজ নেওয়া তাঁর নিয়মের একটি। শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছেও তিনি ছিলেন প্রিয় ব্যক্তিত্ব। সবার সাথে তাঁর আচরণ বন্ধুসুলভ। তাঁর আমলে কলেজ ক্যাম্পাস ছিল প্রায় শান্ত, গল্ডগোল তেমন চোখে পড়েনি। সামাজিক-সংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ রাষ্ট্রীয় নানা কর্মসূচিতে মুখর ছিল পুরো ক্যাম্পাস। কলেজের শিক্ষার মানও আগের তুলনায় অনেক, আকাশ ছোঁয়া। এর পেছনেও অবসরে চলে যাওয়া মানুষটির অবদান অনস্বীকার্য।

এর আগে তিনি কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজেও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।এ কলেজে তিনি ১ বছর ৩ মাস ৮ দিন (২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ) দায়িত্বে ছিলেন। এসময়ও তিনি কলেজের যথেষ্ট উন্নয়ন করেন।কলেজের বর্তমান পাঁচতলা নতুন হোস্টেল,শহীদ মিনার, প্রশাসনিক ভবনের উর্ধমুখি সম্প্রসারণ, পাঠাগার, কম্পিউটার ল্যাব, বাণিজ্য বিভাগ চালু তাঁরই অবদান। যোগদানের পরপর তিনি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গনটি সাজান ফুলের বাগান দিয়ে।ক্যাম্পাসে গেলেই রকমারি ফুলের সৌরভে জুড়িয়ে যেত মন-প্রাণ।যা এখন নেই।
জেলার অন্যতম দুটি সরকারি কলেজে তিনি একাধারে ৮ বছর ৫ মাস ২৩ দিন চাকরি করেন। জেলার ২৫ লাখ মানুষের কল্যাণে একাধারে এতোটা বছর ত্যাগের নজির সম্ভবত অন্যকোনো অধ্যক্ষের নেই। শিক্ষা ক্যাডারে তাঁর মোট চাকুরিকাল ছিল ৩২ বছর ৫ মাস ১ দিন।

এ দীর্ঘ চাকরিজীবনে তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা, সিলেট এমসি কলেজ, চট্টগ্রাম হাজী মুহম্মদ মহসীন কলেজ, রাঙ্গামাটি কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করেন। কক্সবাজার সরকারি কলেজে যোগদানের আগে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে সচিবের দায়িত্বও পালন করেছিলেন কর্মট এই মানুষটি।
দীর্ঘ চাকরি জীবনে তিনি কোন দিন এক মিনিট বিলম্বে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেননি। কোনো সভা-সমাবেশে পৌছেছেন নির্দিষ্ট সময়ে আগেই। দুই ঈদের দুইদিন এবং সাথে আরো দুইদিনসহ চারদিন ছাড়া বছরে অন্যান্য দিন কাটিয়েছেন নিজ কর্মস্থলেই। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিনাকারণে তিনি একদিনও ছুটি ভোগ করেননি।

শিক্ষকতা জীবনে অত্যন্ত মেধাবী, জ্ঞানী ও সৎ এই ব্যক্তির হাতে আলোকিত হয়েছে হাজারো প্রাণ। সেই প্রাণের ছোঁয়ায় গড়ছে সোনার বাংলাদেশ। অবসরকালীন সময়ে সোনার বাংলায় সেই প্রাণের ছোঁয়ায় হয়তো কিছুটা দিন বাঁচার স্বপ্নও দেখতে পারেন নিরহংকারী এই মানুষটি।

# দায়িত্বশীল নিবেদিত মানুষ
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশে প্রতিবছর গণিত উৎসব, বিতর্ক উৎসব, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান মেলা, ভাষা উৎসরের আয়োজন করে আসছে প্রথম আলো । সবকটি উৎসবে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকতেন আমার এই প্রিয় মানুষটি। বিকাল চারটায় অনুষ্টানে আসার কথা তাঁর, পৌঁছতেন দুই ঘন্টা আগে। কারণ জানতে চাইলে বলতেন-ছাত্রছাত্রীদের সাথে থাকতে ভালো লাগে, তাই আগেভাগে ছুটে আসা। কোনো কোনো অনুষ্টানে দাওয়াত দিতে ভুলে যেতাম। স্যার কিন্তু যথাসময়ে হাজির। বলতেন-শিক্ষার কাজে কাউকে দাওয়াত দিতে হয়না।

বন্ধুসভার সদস্যদের (ছেলেমেয়েদের) স্নেহ করতেন তিনি অত্যাধিক ।২০১৯ সালের জুলাই মাসে দেশব্যাপী শিশু অপহরণ গুজব এবং শিশুর মাথা কাটা আতঙ্ক জেঁকে বসেছিল। গণপিটুনীতে তখন অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। কক্সবাজারেও লেগেছিল তার ঢেউ।
গুজব আতঙ্ক দুর করতে অধ্যক্ষ স্যারকে নিয়ে বন্ধুসভার সদস্যরা ছুটে গিয়েছিল দূর্গম ছনখোলা গ্রামে। ছনখোলা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গণপিটুনী গুজব নিয়ে বক্তৃতা শেষ করে অধ্যক্ষ স্যার অংশ নেন বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে।বর্ষার পানিতে ছনখোলার রাস্তাঘাট মাঠ ডুবে থেইথই। কাঁদামাঠে পা ফেলতে আমরা দ্বিধায় ছিলাম, কিন্তু জুতা হাতে নিয়ে প্রথম পাটি ফেললেন এই শিক্ষাগুরু নিজেই। বৃষ্টিতে ভিঁজে তিনি আগে, আমরা সবাই তাঁর পেছনে পেছনে, অতিক্রম বর্ষার সেই প্রান্তর। এরকম সাদাসিধে জীবন কল্পনা করা যায় ?
বন্ধুসভার সদস্যদের সবসময় সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকার পরামর্শ এবং উৎসাহ যোগাতেন এই ত্যাগী মানুষটি।

আবার বিতর্কিত কোনো অনুষ্টানে অতিথি হিসাবে গিয়ে বিপদেও পড়তেন মানুষটি। কারণ জানতে চাইলে হেসে বলতেন-কী করবো, কাউকেতো না করতে পারিনা।
মানুষ চিনতে ভুল করতেন তিনি। মানুষের প্রতি এতো বিশ্বাস অন্য কারো মাঝে দেখিনি।

দুই পুত্র সন্তানের জনক অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল করিম চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। তাঁর সহধর্মীনি চট্টগ্রাম বাকলিয়া সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। বিগত আট বছরে তিনি (সহধর্মীনি) কক্সবাজারে এসেছিলেন মাত্র সাতবার। সর্বশেষ গত জানুয়ারি মাসে এসেছিলেন তিনি। স্যার তাঁকে সেন্ট মার্টিন দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

কলেজ ক্যাম্পাসে গেলেই হোস্টেলে নিয়ে খাইয়ে দিতেন প্রিয় মানুষটি। হোস্টেলের সমস্যা, ছাত্রীদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরতেন তিনি।কলেজ শেষে হাঁটার অভ্যাস তাঁর। কলেজ থেকে হেঁটে হেঁটে পৌঁছতেন কয়েক কিলোমিটার দূরের সমুদ্রসৈকতে। সেখান থেকে হেঁটেহেঁটে ঝাউতলায় আমার অফিসে। কিছুই খাওয়ানো যেত না তাঁকে। স্যারের মাংস খাওয়ার অভ্যাস নেই মোটেও । অবসরকালীন জীবনটাও সম্ভবত তাঁকে কাটাতে হবে সবজি আর মাছে।
ছোট বড় সবার সঙ্গে কথা বলেন তিনি হেসে হেসে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ তিনি, অথচ চলাফেরা সাধারণ কর্মচারীর মতো ব্যাটারী চালিত ইজিবাইক ‘টমটম’ দিয়ে, কল্পনা করা যায় ?

স্যারকে প্রায় সময় বলতাম-কলেজ ফান্ডেতো কোটি টাকা পড়ে আছে, একটা গাড়ি কিনে ফেললে হয়। কলেজের অন্যান্য শিক্ষকেরাও গাড়ি কেনার পক্ষে যুক্তি দেখাতেন। কিন্তু তিনি তাতে মোটেও রাজি না। বলতেন গাড়ি দিয়ে কি করবো-এই কয়েকটা মাস পরেই তো চলে যাচ্ছি।

স্যার চলে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু কক্সবাজারবাসীকে কাঁদিয়ে। করোনাকাল বলেই সেই ক্রন্দন কানে বাজছেনা কারো । করোনাকাল বলেই বিদায়ের গণসংবর্ধনাগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে না।
কথায় বলে, ভালো সময় নাকি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। কিন্তু আমরা আপনার স্মৃতি ফুরিয়ে যেতে দিবনা কিছুতেই। আমরা সহজে আপনাকে হারাতেও দিবনা। আপনার কীর্তিকর্ম জেগে থাকবে লাখো প্রাণের গহিনে। আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকবেন, সুন্দর থাকবেন-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আপনার সুস্থ্ ও দীর্ঘায়ূজীবন কামনা করি সবসময়-প্রতিদিন।

 

২৭ জুন-২০২০

 

লেখক: আব্দুল কুদ্দুস রানা

অফিস প্রধান, প্রথম আলো, কক্সবাজার অফিস।

লেখাটি সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস রানার ফেসবুক থেকে সংগৃহিত।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •